প্রকাশিত: Sun, Dec 18, 2022 4:22 AM
আপডেট: Sun, Jun 22, 2025 6:37 AM

আর্জেন্টিনা-ফ্রান্স : কে কার আগে!

মিরাজুল ইসলাম 

কাতার বিশ্বকাপ আসরের ফাইনাল উপলক্ষ্যে শতকোটি মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রে এখন ১৮ ডিসেম্বর। আর্জেন্টিনা ও ফ্রান্সের ফুটবল লড়াই আদতে হয়ে পড়েছে দুইজন ফুটবলার কেন্দ্রিক। মেসি ও এমবাপ্পে। পিএসজি ক্লাবে দু’জনেই সতীর্থ। সেখানে মেসির অভিজ্ঞতায় নিজেকে ঋদ্ধ করেছেন একথা অনেকবার বলেছেন ফরাসি তারকা এমবাপ্পে। মেসির মতো সাতটি ব্যালন ডি অর দূরের কথা, একটিবারের জন্যও ফিফার সেরা খেলোয়ার নির্বাচিত না হলেও দুই দিক থেকে তিনি এগিয়ে আছেন মেসির চেয়ে। বয়সে নবীন এবং ২০১৮ বিশ্বকাপ জয়ের অভিজ্ঞতাÑ এই দুইটি নিয়ামককে পুঁজি করে আগামী রোববারে কাতারে লড়াই করবেন মেসির বিপক্ষে। অন্যদিকে লিওনেল মেসি দাঁড়িয়ে আছেন ইতিহাসের মাহেন্দ্রক্ষণে।

আধুনিক ফুটবলে ব্যক্তিগত অর্জনে লিওনেল মেসির সমকক্ষ হওয়া হয়তো অসম্ভব ব্যাপার। আমরা ভাগ্যবান মেসিকে খেলতে দেখছি। মেসিকে টপকে আটবার ব্যালন ডি অর জেতার মতো ফুটবলার আপাতত ইউরোপ-আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকা-এশিয়ার ফুটবলাঙ্গনে দেখা মেলেনি। ইদানীং তরুণদের মধ্যে যারা প্রতিশ্রুতিশীল কিংবা ভালো খেলছেন তারা বড়জোর এক বা দুইটি ব্যালন খেতাব জয়ের যোগ্যতা রাখেন। ফরাসি তারকা কিলিয়ান এমবাপ্পে তাদের মধ্যে একজন। অবশ্য একই মাপের যোগ্যতা ব্রাজিলের নেইমারের মধ্যেও ছিল এবং আছে। কিন্তু তাদের দুর্ভাগ্য এরা সবাই মেসি-যুগে খেলছেন। যতদিন লিওনেল মেসি পুরোপুরি বুটজোড়া তুলে রেখে অবসরে না যাচ্ছেন ততোদিন নতুন প্রতিভাদের অপেক্ষায় থাকতে হয়েছে। সেক্ষেত্রে ফুটবল বিশ্বে পাঁচবার ব্যালন জয়ী ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর অবদানের কথাও স্মরণ করতে হবে। এবারের বিশ্বকাপ ছিল মেসির সাথে তার শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে যোগ্যতর প্রমাণের শেষ সুযোগ। পারলেন না রোনালদো নিজেকে এবং পর্তুগালকে সাফল্য এনে দিতে।

পক্ষান্তরে মেসি নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। ক্লাব ফুটবল পর্যায়ে সম্ভাব্য সকল পদক-শিরোপা-খেতাব অর্জন করেছেন। দেশের হয়েও জিতে নিয়েছেন কোপা কাপ শিরোপা। ২০১৪ সালে স্পর্শ করতে গিয়েও পারেননি বিশ্বকাপ। এবার আরেকবার দলকে ফাইনালে পৌঁছাতে সর্বোচ্চ সহায়তা করলেন। যেভাবে ২০২১ সালে কোপা আমেরিকা জয়ে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। কিন্তু ফুটবল বিশেষজ্ঞদের চোখে মেসি কোপা আমেরিকার চেয়ে সুন্দর এবং বিধ্বংসী।  

যদিও ২০১৪ কিংবা ২০১৮ সালের বিশ্বকাপের মতো এবারের আর্জেন্টিনা মেসি-নির্ভর দল নয়। ২০১৮ সালের বিশ্বকাপ পরাজয়ের পর লিওনেল স্কালোনি নতুন কোচ নিযুক্ত হবার পর বদলে গেছে আর্জেন্টিনা। মেসি নির্ভরতা পুরোপুরি না কাটলেও মেসিকে সহায়তা করার জন্য এই দলে এখন প্রস্তুত একঝাঁক নবীন প্রতিভা। এনজো ফার্নান্দেজ, হুলিয়ান আলভারেজ, মলিনা, ডি পল, রোমেরো, লাউতারো, ইমি মার্তিনেজ আগামী দিনের তারকা হিসেবে নিজেদের অবস্থান প্রমাণ করেছেন। তাদের সাথে আছেন মেসির পরীক্ষিত সঙ্গী আনহেল ডি মারিয়া। 

গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচে সৌদি আরবের সাথে পরাজয় যেন শাপে বর হয়েছিল আর্জন্টিনার জন্য। ফাইনালে ওঠার পথে ১২টি গোল করে তারা। এর মধ্যে ৫টি গোল এবং ৩টি অ্যাসিস্ট নিয়ে যথারীতি মেসি এগিয়ে আছেন গোল্ডেন বল ও গোল্ডেন বুট প্রতিযোগিতায়। অন্যদিকে ফাইনালের পথে ফ্রান্স করেছে ১৩টি গোল। এমবাপ্পে তাদের পক্ষে সর্বোচ্চ ৫টি গোল এবং ২টি অ্যাসিস্টের মাধ্যমে নিঃশ্বাস ফেলছেন মেসির ঘাড়ে। যদিও আরেকটি ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকছেন মেসি। মোট চারবার ম্যান অব দ্যা ম্যাচ হয়েছেন, এমবাপ্পে হয়েছেন দুইবার।

আর্জেন্টিনার সমর্থকরা জানে এটাই মেসির শেষ সুযোগ। একইভাবে মেসির সতীর্থরাও প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছে ২০১৪ সালের ব্যর্থতা ঢাকতে এবং লিওনেল মেসির সম্মানার্থে তারা জীবনপণ রেখে মাঠে তাদের সর্বস্ব বয়েসের দেবে। কোপা জয়ের পর থেকে দলীয় সংহতি এমন পর্যায়ে আছে তা যেকোনো দলের জন্য নিঃসন্দেহে চ্যালেঞ্জের বিষয়। হল্যাণ্ডের বিপক্ষে কোয়ার্টারফাইনালে তার নমুনা আমরা দেখেছি। এমন লড়াকু মানসিকতা নিয়ে আর্জেন্টিনা যদি ফাইনালে ফিরে আসে তবে কোচ দেশমের রেকর্ড গড়ার স্বপ্ন অধরা থেকে যাবে।

এরই সাথে পর্যায়ক্রমে প্রতিটি ম্যাচে মেসি প্রমাণ করে চলেছেন পঁয়ত্রিশ বছর বয়স স্রেফ একটা সংখ্যা। গ্রুপ পর্বে মেক্সিকোর সাথে বুলেট গতির মাটি ঘেঁষা শটে গোল কিংবা ক্রোয়েশিয়ার বিশ বছরের তরুণ ডিফেন্ডার গার্দিওলকে লম্বা দৌড়ে পরাজিত করে অনিন্দ্যসুন্দর অ্যাসিস্ট দেখে একটিবারের জন্য মনে হয়নি মেসি তার জীবনের শেষ বিশ্বকাপ খেলতে এসেছেন। এমন দুর্দান্ত ফর্মে যেকোনো ফুটবলার চাইবেন আরো চার বছর খেলা চালিয়ে যেতে। 

পেছন ফিরে তাকালে দেখবো, ইতিহাসের প্রেক্ষিতে পার্থক্য থাকলেও আর্জেন্টিনা-ফ্রান্স ফাইনালের আমেজে সমিল পাওয়া যাবে ১৯৯০ সালের বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা-ইতালির সেমিফাইনাল ম্যাচের আবহ। সেবার ইতালির নেপলস স্টেডিয়ামে দিয়াগো ম্যারাডোনাকে কঠিন লড়াই করতে হয়েছিলো কাগজে-কলমে শক্ত প্রতিপক্ষ মালদিনি-ডোনাডুনি-রবার্তো ব্যাজিও এবং সেই বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ গোলদাতা শিলাচির শিরোপা প্রত্যাশী ইতালির বিপক্ষে। ম্যারাডোনা সেই সময় ছিলেন ইতালির নেপোলি ক্লাবের সেরা তারকা। 

একই ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে লিওনেল মেসিকে। মেসি নিজেও এখন খেলেন ফরাসি ক্লাব পিএসজিতে। শুধু তাই নয়, ক্লাবের অন্যতম জনপ্রিয় তারকা হিসেবে মেসিকে লড়তে হবে ক্লাব সতীর্থ এমবাপ্পের সাথে। সবাই জানেন ২০২১ মৌসুমে পিএসজিতে এমবাপ্পের তুলনায় অনেক বেশি কার্যকর ভূমিকায় ছিলেন মেসি, প্রথম মৌসুমের তুলনায়। মেসিকে ঘিরেই মূলত প্যারিসবাসী তাদের প্রথম চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপার স্বপ্ন দেখছে। অথচ এই মুহূর্তে পুরো প্যারিস এবং ফ্রান্স অনিচ্ছা সত্ত্বেও মেসির পরাজয় দেখতে চায়। যদিও তারা জানে, মেসি বিশ্বকাপে ব্যর্থ হলে আগামীতে পিএসজিতে তার প্রভাব পড়তে বাধ্য। যেভাবে ১৯৯০ সালে নেপলসবাসী ম্যারাডোনাকে নিয়ে দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিল। বলা বাহুল্য, ইতালিকে টাইব্রেকারে পরাজিত করবার পর নেপোলিতে ম্যারাডোনার ক্লাব ক্যারিয়ারের সমাপ্তি ঘটেছিলো। ইতালি এই পরাজয় মানসিকভাবে মেনে নিতে পারেননি। আরো ব্যাপার আছে, ফ্রান্সকে মোকাবেলা করতে গিয়ে মেসিকে লড়তে হবে বার্সেলোনায় তার প্রাক্তন প্রিয় সতীর্থ উসমান ডিম্বলে এবং আঁতোয়ান গ্রীজম্যানের বিপক্ষেও। 

উল্লেখ্য, বার্সেলোনায় গ্রীজম্যানের গোল খরা কাটাতে মেসি তার নিজের পেনাল্টি শুধু তাকে উপহার দেননি বরং গোল অ্যাসিস্ট করে এই ফরাসি তারকার মনোবল বজায় রাখতেও মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। নিশ্চয় ফাইনালে মুখামুখি হবার সময় আবেগবর্জিত মনোভাব বজায় রাখলেও এমবাপ্পে, গ্রীজম্যান এবং ডিম্বলে কখনো ভুলবে না খেলার মাঠে মেসির স্পোর্টসম্যানশিপের প্রভাব এবং সামর্থ্যকে। এছাড়াও ফ্রান্সের অন্যতম সেরা ফুটবলার করিম বেনজেমা যদি দলে অন্তর্ভুক্ত হতেন তিনিও জানেন মেসি কতটা কার্যকর। 

রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে খুব কাছ থেকে মেসিকে দেখার অভিজ্ঞতা বেনজেমার রয়েছে। তিনি ভালো করেই জানেন ঠিক সময়ে মেসি ঝলসে উঠলে ফরাসীদের বাগাড়ম্বর কিংবা দলীয় শক্তি কাজে দেবে না।

মেসি এবং এমবাপ্পে ছাড়া আর্জেন্টিনা এবং ফ্রান্সের পক্ষে ৪টি করে গোল করেছেন হুলিয়ান আলভারেজ এবং অলিভার জিরু। তাদের ভূমিকাও যথেষ্ট থাকবে খেলার ফলাফল নির্ধারণে। সাবেক আর্সেনাল তারকা জিরু তার পুরানো রূপে ফিরে এসেছেন। এটি ফ্রান্সের জন্য সুসংবাদ অবশ্যই। তবে মধ্যমাঠে যারা ভালো খেলবে ধরে নেওয়া যায় শিরোপা লড়াইয়ে তারাই এগিয়ে থাকবে। এক্ষেত্রে আর্জেন্টিনার আরেক তারকা ডি মারিয়া সুস্থ থাকলে ফ্রান্সকে বেগ পেতে হতে পারে মধ্যমাঠের দখল নিতে। খেলোয়ার এবং কোচ হিসেবে ফ্রান্সের পক্ষে দুইবার বিশ্বকাপ জিতেছেন দিদিয়ের দেশম। মেসিকে আটকানোর পাশাপাশি মধ্যমাঠ দখল করে এমবাপ্পে-গ্রীজম্যান কিংবা থিও-জিরু জুটি কতটা কার্যকর হয়ে ওঠে সেই স্ট্র্যাটেজি দেশম কিভাবে সাজান তার উপর নির্ভর করছে ফরাসীদের ম্যাচ ভাগ্য। 

অন্যদিকে প্রতিটি খেলায় ভিন্নতর ফর্মেশনে দলকে খেলিয়েছেন আর্জেন্টিনার তরুণ কোচ স্কালোনি। ২০০৬ সালে তরুণ মেসি বর্তমান কোচের সতীর্থ ছিলেন। শুধু তাই নয় কোচের সহকারী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়া পাবলো আইমার ছিলেন মেসির অন্যতম আইডল। সেই হিসেবে মেসির সাথে সহজাত মিথষ্ক্রিয়া গড়ে উঠেছে কোচিং স্টাফদের। যা সহজে সঞ্চারিত হয়েছে নবীন খেলোয়ারদের মাঝে। ইতিপূর্বে মেসিকে যথাযথভাবে দলের ভেতর মানিয়ে নিতে বেগ পেতে হয়েছিল জাতীয় দলের প্রাক্তন কোচদের। ২০১০ সালেও কোচ হিসেবে দিয়াগো ম্যারাডোনা পারেননি মেসির প্রতিভা যথার্থ ব্যবহার করতে। বার্সেলালো ক্লাব পর্যায়ে পেপ গার্দিওলা, লুই এনরিখে যা পেরেছিলেন কিংবা পিএসজির বর্তমান কোচ গ্যালতিয়ার যেভাবে মেসির প্রতিভা কাজে লাগাতে পারছেন তার চেয়েও অনেক বেশী মেসিকে অনুধাবন এবং ধারন করতে সক্ষম হয়েছেন স্কালোনি এবং আইমার। মেসির খেলার ধরনে পরিবর্তন এবং বিবর্তনে তা স্পষ্ট। দলের প্রয়োজনে মেসি কেবল নিজেই খেলেন না, পুরো দলকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন। 

সেই নিরিখে অবশ্যই বলতে হবে এমবাপ্পের গতি-স্কিল কিংবা গ্রীজম্যান-জিরুর অভিজ্ঞতা যত গভীর হোক না কেন, মেসি যদি ম্যাচ নিয়ন্ত্রণ নিজের পায়ে নিয়ে নেয় এক জম্পেশ ফাইনালের সাক্ষী আমরা হতে পারি। সেই হিসেবে ২০২২ বিশ্বকাপের ফাইনালে মেসি-এমবাপ্পের অভিজ্ঞ প্রতিভা বনাম নবীন প্রতিভার লড়াইটা কেবল তাদের দুজনের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকবে ভাবাটা ঠিক হবে না। দুজনেই পুরো মাঠ নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলেও মনস্তাত্ত্বিক পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারাটা হবে মূল কৌশল। কোনো সন্দেহ নেই মেসি অমরত্বের শেষ ধাপে পৌঁছাতে চান। তার সতীর্থরা প্রস্তুত নিজেদের উজাড় করে দিতে। ফ্রান্স চায় পরপর দুইবার বিশ^কাপ জিতে ইতিহাসের পাতায় নাম লেখাতে। লাতিন বনাম ইউরোপের দ্বৈরথে ফলাফল যাই হোক সারা বিশ্ব দেখবে ফুটবলের বিজয়। এক স্নায়ুক্ষরা জমজমাট স্মরণীয় ফাইনালের প্রত্যাশায় উন্মুখ হয়ে আছে গোটা বিশ্ব। তবে একই সাথে সুন্দর ফুটবলের জয় হলে তা হবে সোনায়- সোহাগা। লেখক ও চিকিৎসক